দূরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্ক: হরিয়ানার মেয়ে। ট্রাভেল ব্লগ বানাতেন ঘুরে ঘুরে। আর তথ্য পাচার করতেন পাকিস্তানে। এককথায় ইউটিউবার থেকে পাকিস্তানের গুপ্তচর। জ্যোতি মালহোত্রার কাহিনী আধুনিক যুদ্ধশাস্ত্রের সংজ্ঞাই পাল্টে দিচ্ছে। কিন্তু পুলিশের দাবি, পর্দার আড়ালে তিনি ছিলেন এক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সক্রিয় অংশ — পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি চালাতেন। হরিয়ানার হিসার জেলার বাসিন্দা জ্যোতি মালহোত্রাকে শুক্রবার ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। আদালত তাঁকে পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজতে পাঠিয়েছে।
কোভিড পরবর্তী সময়ে কনটেন্ট তৈরির জগতে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন জ্যোতি। ‘Travel with Jo’ নামক ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে তাঁর প্রায় ৩.৭ লক্ষ সাবস্ক্রাইবার ছিল। ইনস্টাগ্রামেও তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা লক্ষাধিক। তবে জনপ্রিয়তার আড়ালে চলছিল এক ভিন্ন খেলা। পুলিশ জানিয়েছে, জ্যোতি ইতিমধ্যেই আটটি দেশে ভ্রমণ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান, চীন ও বাংলাদেশ। পাকিস্তানে তাঁর একাধিক স্পন্সরড সফরের তথ্য সামনে এসেছে। ২০২৩ সালে তিনি পাকিস্তানে ১০ দিনের ভিসা নিয়ে যান। সেখানেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে আইএসআই-ঘনিষ্ঠ দানিশ, আলি আহওয়ান, শাকির এবং রানা শাহবাজের মতো ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে। তদন্তে উঠে এসেছে, পাকিস্তানে ভ্রমণের পর থেকেই জ্যোতি হোয়াটসঅ্যাপ, স্ন্যাপচ্যাট ও টেলিগ্রামের মতো এনক্রিপ্টেড প্ল্যাটফর্মে ওইসব ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। সন্দেহ এড়াতে শাকিরের নাম ‘জাট রানধাওয়া’ ছদ্মনামে ফোনে সেভ করে রেখেছিলেন তিনি। পুলিশের দাবি, পরবর্তীতে ভারতে ফিরে এসে তিনি নানান সংবেদনশীল তথ্য পাঠাতে শুরু করেন। ইতিমধ্যেই তাঁর আর্থিক লেনদেন, বিলাসবহুল জীবনযাপন, এবং বিদেশ সফরের খরচ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হিসার পুলিশের সুপার শশাঙ্ককুমার সাওয়ান বলেন, ‘‘আমরা তাঁর অ্যাকাউন্টে লেনদেন, কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন, কার সঙ্গে দেখা করেছিলেন— সব দেখছি।’’ পুলিশের একটি সূত্র বলছে, বেড়াতে গিয়ে জ্যোতি থাকতেন বিলাসবহুল হোটেলে। খাওয়াদাওয়া করতে বিখ্যাত রেস্তরাঁয়।
পুলিশ জানিয়েছে, জ্যোতির পাকিস্তান সফরের খরচ জুগিয়েছিলেন অন্য কেউ। কে বা কারা টাকা দিয়েছিলেন তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তদন্তে পুলিশ এ-ও জেনেছে, পাকিস্তানে রীতিমতো ‘ভিআইপি’দের মতো সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন তিনি। পাকিস্তান থেকে ফিরে তিনি গিয়েছিলেন চিনে। সে দেশেও বিলাসবহুল গাড়িতে চেপে ঘুরেছিলেন তিনি। গয়নার দোকানে গিয়েছিলেন। তদন্তকারীদের একটা অংশ মনে করছে, টাকার টানেই পাকিস্তানি চরদের ফাঁদে পা দিয়ে থাকতে পারেন জ্যোতি।
পাশাপাশি তদন্তকারীদের মতে, জ্যোতির জীবনযাপন তাঁর ঘোষিত আয়ের সঙ্গে মেলে না। তিনি নিয়মিত ফার্স্ট ক্লাসে ভ্রমণ করতেন, বিলাসবহুল হোটেলে থাকতেন এবং দামী রেস্তোরাঁয় খেতেন। প্রাথমিক অনুমান, পাকিস্তান থেকেই এসব খরচ বহন করা হত। নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাই কমিশনের আধিকারিক এহসান-উর-রহিম ওরফে দানিশের সঙ্গে ধৃত ইউটিউবার জ্যোতি মলহোত্রার ‘ঘনিষ্ঠতা’ এখন পুলিশের নজরে। ওই পাক আধিকারিকের সঙ্গে কী ভাবে যোগাযোগ হয়েছিল জ্যোতির, তাঁকে গোপন তথ্য পাচার করতেন কি না, সে সব অনুসন্ধান করে দেখছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের নজরে রয়েছে, ইউটিউবে জ্যোতির পোস্ট করা বেশ কিছু পুরনো ভিডিয়ো। সূত্রের খবর, দানিশের সঙ্গে জ্যোতির ‘ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ’ রয়েছে একটি ভিডিয়োতে।
জানা যাচ্ছে, শুধুমাত্র হরিয়ানাতেই নয় — বারবার পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন জ্যোতি। কলকাতা থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গ, নদিয়া, এমনকি সীমান্তবর্তী এলাকাতেও তাঁর যাতায়াত ছিল নিয়মিত। পুলিশ সূত্রে খবর, এবারেও কলকাতায় আসার সময় জ্যোতির সঙ্গে ছিলেন বাংলারই আর এক জনপ্রিয় ট্র্যাভেল ব্লগার সৌমিত ভট্টাচার্য। ব্যারাকপুর, শেড়াফুলি, লিলুয়া — একাধিক স্থানে একসঙ্গে ঘোরাফেরা করেছেন তাঁরা। ব্যারাকপুরের একটি জনপ্রিয় বিরিয়ানি রেস্তোরাঁতেও একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন তাঁরা। শুধু তাই নয়, তিন মাস আগেও জ্যোতি কলকাতায় এসেছিলেন। তখনও হাওড়া স্টেশন থেকে তাঁকে স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন সৌমিত।
ব্যারাকপুরে একসঙ্গে লঞ্চ সফর এবং লিলুয়ায় আর এক ইউটিউবার মোহিতের বিয়েতে অংশগ্রহণ — সবই ধরা আছে জ্যোতির ইউটিউব ভিডিওতে।জ্যোতির বাবা হ্যারিস মালহোত্রা জানিয়েছেন, জ্যোতি ইউটিউব ভিডিও শ্যুট করার জন্য পাকিস্তানে গিয়েছিলেন এবং প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়েই সেখানে যেতেন। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, "ইউটিউবের জন্য ভিডিও শ্যুট করার জন্য পাকিস্তান এবং অন্যান্য জায়গায় যেত জ্যোতি।" পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, "যদি তাঁর সেখানে কিছু বন্ধু থাকে, তাহলে কি সে তাঁদের ফোন করতে পারবেন না? আমার কোনও দাবি নেই, তবে আমাদের ফোন দিন। আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।" ইউটিউবারের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এবং ভারতীয় ন্যায় সংহিতার প্রাসঙ্গিক ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
এই সফরগুলির সময় জ্যোতি কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা ভিডিও সংগ্রহ করেছিলেন কিনা, তা খতিয়ে দেখছে তদন্তকারী সংস্থা। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তাঁর উপস্থিতি নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ভিডিও শ্যুটের আড়ালে সেনা মোতায়েন, কৌশলগত স্থাপনা বা সীমান্ত নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন কিনা, তা জানতে তাঁর সমস্ত কনটেন্ট ও ডিভাইস বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি জ্যোতির ভ্রমণের নেপথ্যে প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল, এবং তিনি কাউকে তথ্য পাঠিয়েছেন কি না, তা জানতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সঙ্গে একযোগে তদন্ত চালাচ্ছে রাজ্য পুলিশও। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি, তবে গোয়েন্দা মহলে বিষয়টি নিয়ে তীব্র উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। তদন্ত চলাকালীন আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।