দুরন্তবার্তা ডিজিটাল ডেস্ক :কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) এই যুগে বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা আলাদা করা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। আধুনিক এআই টুল দিয়ে তৈরি নানা ভিডিওতে এমনভাবে ঘটনাপ্রবাহ দেখানো হয় যে, তা একেবারে বাস্তব মনে হয়। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো একটি চাঞ্চল্যকর ভিডিও, যেখানে দাবি করা হচ্ছে—“জেসিকা র্যাডক্লিফ” নামে এক সামুদ্রিক প্রশিক্ষককে লাইভ শো চলাকালীন একটি অর্কা বা কিলার হোয়েল প্রাণঘাতীভাবে আক্রমণ করেছে। ভিডিওটি ইতিমধ্যেই TikTok, Facebook এবং X-এ ভাইরাল হয়েছে। তবে একাধিক ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা নিশ্চিত করেছে, ফুটেজটি সম্পূর্ণ ভুয়া এবং এর সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই।
ভাইরাল হওয়া ক্লিপটিতে দেখা যায়, প্যাসিফিক ব্লু মেরিন পার্কে এক তরুণী অর্কার পিঠে দাঁড়িয়ে নাচ করছেন। তিমিটি জলের বাইরে লাফিয়ে উঠতেই দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই দৃশ্য বদলে যায়—অর্কা হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তথাকথিত "জেসিকা র্যাডক্লিফ"কে জলের গভীরে টেনে নিয়ে যায়। ভিডিওটি শেয়ার করা অনেক ব্যবহারকারী দাবি করেছেন, জলের বাইরে টেনে তোলার কিছু মিনিটের মধ্যেই ওই নারী প্রাণ হারান।
ভিডিওটি ব্যাপকভাবে শেয়ার হলেও, "জেসিকা র্যাডক্লিফ" নামে কোনো সামুদ্রিক প্রশিক্ষককে কিলার হোয়েল আক্রমণ করেছে—এমন দাবির পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ মেলেনি। কর্তৃপক্ষ, সামুদ্রিক উদ্যান এবং প্রধান সংবাদমাধ্যম কোথাও তাঁর অস্তিত্ব বা এমন ঘটনার কোনো রেকর্ড খুঁজে পায়নি। দ্য স্টার প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ফুটেজটি সম্পূর্ণ মনগড়া; এমনকি ভিডিওতে শোনা কণ্ঠস্বরও কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
অন্যান্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে সাধারণত সামুদ্রিক উদ্যানগুলোর তরফে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়, কিন্তু এই ঘটনায় তেমন কিছুই প্রকাশিত হয়নি। উপরন্তু, জলের অস্বাভাবিক গতিবিধি ও ভিডিওতে থাকা অদ্ভুত বিরতি—যা ফরেনসিক বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে—স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে এটি এআই-নির্মিত ফুটেজ। এমনকি ভিডিওতে ব্যবহৃত পার্কের নামও ভুয়া বলে নিশ্চিত হয়েছে।
ফোবর্স ভিডিওটিকে সরাসরি "প্রতারণা" বলে আখ্যা দিয়ে জানিয়েছে, যদি সত্যিই এত বড় ধরনের কোনো ট্র্যাজেডি ঘটত, তবে তা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রধান শিরোনামে থাকত। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ভিডিওর ভিজ্যুয়াল ও অডিও এফেক্ট সম্ভবত কেবল চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এআই টুল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। একইভাবে ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, গল্পে উল্লেখিত ঘটনা ও নামের কোনো যাচাইযোগ্য রেকর্ড নেই—যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে পুরো কাহিনিই মনগড়া।
এই ধরনের ভুয়া ভিডিওগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় কারণ সেগুলোতে কিছুটা বাস্তব ঘটনার ছায়া ব্যবহার করা হয়। যেমন—২০১০ সালে সিওয়ার্ল্ডে ডন ব্রাঞ্চো এবং ২০০৯ সালে অ্যালেক্সিস মার্টিনেজের করুণ মৃত্যু, যাঁরা দু’জনেই অরকার আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তবে এই ঘটনাগুলো একেবারেই আলাদা এবং সু-নথিভুক্ত, যেখানে তথাকথিত র্যাডক্লিফের কাহিনির কোনো সরকারি সমর্থন বা নিশ্চিত প্রমাণ নেই।
অতীতে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে কোনও ভিডিওর আবেগময় তীব্রতা ও বাস্তবসম্মত উপস্থাপনা প্রায়ই সেটিকে ভাইরাল করে তোলে। এই ধরনের ক্লিপ একদিকে যেমন বুদ্ধিমান সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বন্দিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে, অন্যদিকে চাঞ্চল্যকরতা ছড়িয়ে দিতে ব্যবহার হয়—প্রায়শই তথ্য যাচাইয়ের আগেই।
তবে, “জেসিকা র্যাডক্লিফ”-এর উপর অরকা হামলার কথিত ভিডিও সম্পূর্ণ মনগড়া। এর পেছনে কোনও বাস্তব ঘটনা নেই, এমনকি ওই নামে কোনও প্রশিক্ষকের অস্তিত্বেরও প্রমাণ মেলেনি। অনলাইনে এ ধরনের ভুয়া কাহিনি ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বাসযোগ্য উৎস থেকে তথ্য যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।