দূরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্ক: নাগ পঞ্চমী হল হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, যেখানে নাগ দেবতার পূজা করা হয়। শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। এই দিনে সাপের পূজা করা হয়, এবং মনে করা হয় যে এতে পরিবারে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় থাকে এবং সাপের ভয় থেকেও মুক্তি মেলে। এই উৎসবকে ঘিরে নানা পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্প নিচে তুলে ধরা হল।
নাগপঞ্চমীর নির্ঘণ্ট:
পঞ্চমী তিথি আরম্ভ—
বাংলা: ১১ শ্রাবণ, সোমবার।
ইংরেজি: ২৮ জুলাই, সোমবার।
সময়: দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট।
পঞ্চমী তিথি শেষ—
বাংলা: ১২ শ্রাবণ, মঙ্গলবার।
ইংরেজি: ২৯ জুলাই, মঙ্গলবার।
সময়: দুপুর ৩টা ১৫ মিনিট।
২৯ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার ষট পঞ্চমী ব্রতম, নাগপঞ্চমী, শ্রীশ্রী মনসা দেবী ও অষ্টনাগ পুজো।
নাগপঞ্চমী ব্রত পালনের নিয়ম:
১। নাগপঞ্চমীর দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে স্নান করে নিতে হবে। তার পর বাড়িতেই আটা বা গোবর দিয়ে নাগদেবতার মূর্তি তৈরি করে নিতে পারেন। মূর্তি বানানো সম্ভব না হলে বাজার থেকে নাগদেবতার ছবিও কিনে আনা যেতে পারে।
২। মূর্তি বা ছবিটি যে স্থানে বসাবেন, সেই জায়গাটিকে ভাল করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। নাগদেবতার ছবি বা মূর্তিটিকেও গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করিয়ে নিতে হবে। তার পর সেটিকে পুজো করতে হবে।
৩। সাধারণ ফুল ও দূর্বা দিয়ে নাগদেবতার পুজো করুন। ভোগ হিসাবে দুধ ও কলা অবশ্যই দিতে হবে। এ ছাড়া তিন বা পাঁচ রকমের মিষ্টি, ফলমূল, ক্ষীর প্রভৃতি জিনিস দেওয়া যেতে পারে।
৪। নাগদেবতাকে পাঁচ রকমের জিনিস অর্পণ করে পুজো করতে পারলে খুব ভাল হয়। বিশেষ ফল পেতে চেলি, হলুদ, চন্দন, ফুল ও চাল নিবেদন করে নাগদেবতার আরাধনা করুন।
৫। দুধের মধ্যে ঘি ও চিনি মিশিয়ে নাগদেবতাকে অভিষেক করুন। ধূপ ও প্রদীপ জ্বালান। নাগমন্ত্র জপ করুন। নাগপঞ্চমীর কথা শুনুন।
৬। এই দিন আমিষ খাবার খাবেন না। বদলে নিরামিষ আহার গ্রহণ করবেন।
৭। নাগপঞ্চমীর দিন মহাদেবের পুজো করলেও খুব ভাল ফল পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করা হয়। এই দিন মহাদেবের সামনে প্রদীপ জ্বালান ও তাঁর অভিষেক করুন। সম্ভব হলে মহাদেবকে এই দিন রুপোর তৈরি নাগ-নাগিনী নিবেদন করুন।
নাগপঞ্চমীর ব্রত পালনের ফলাফল:
নাগপঞ্চমীর ব্রত পালনে কালসর্প দোষের কুপ্রভাব থেকে অনেকটা মুক্তি পাওয়া যায়। মহাদেবের আশীর্বাদ লাভ হয়। সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ হয়। নানা অশান্তি থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
আজ নাগ পঞ্চমী। মহাভারত থেকে জানা যায়, কুরু বংশীয় রাজা পরিক্ষিৎ তক্ষক নাগের আঘাতে মারা গেলে তাঁর পুত্র জন্মেজয় পৃথিবী সর্পশূন্য করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। তিনি এক সর্পযজ্ঞ শুরু করেন, যেখানে মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কোটি কোটি সাপ যজ্ঞানলে পড়ে মারা যেতে থাকে। এই সময়ে জরৎকারু মুনির পুত্র আস্তিক এই নিষ্ঠুর যজ্ঞ বন্ধ করতে জন্মেজয়ের কাছে পৌঁছান এবং তাঁরই হস্তক্ষেপে জন্মেজয় এই ভয়ঙ্কর কর্ম থেকে নিরস্ত হন।
সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনিগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। মনে করা হয়, শ্রীকৃষ্ণ যখন শিশু ছিলেন, তখন যমুনা নদীতে কালিয়া নামক এক বিশাল বিষধর সাপ বাস করত। এই সাপের বিষে যমুনার জল বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং এর প্রভাবে গোকুলের মানুষ ও পশুপাখিদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠছিল। একদিন শ্রীকৃষ্ণ বল খেলতে গিয়ে বলটি যমুনা নদীতে ফেলে দেন। বল আনতে গিয়ে তিনি কালিয়া নাগের মুখোমুখি হন। কালিয়া নাগ শ্রীকৃষ্ণকে গ্রাস করার চেষ্টা করলে, শ্রীকৃষ্ণ তার বিরাট রূপ ধারণ করেন এবং কালিয়া নাগের ফণার উপর নৃত্য করতে শুরু করেন। শ্রীকৃষ্ণের নৃত্যের প্রভাবে কালিয়া নাগ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নিজের ভুল বুঝতে পেরে শ্রীকৃষ্ণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। শ্রীকৃষ্ণ কালিয়াকে প্রতিশ্রুতি দেন যে সে যদি যমুনা নদী ছেড়ে সমুদ্রে চলে যায়, তাহলে তিনি তাকে কোনো ক্ষতি করবেন না। কালিয়া নাগ সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং সেদিন থেকেই এই তিথিতে নাগ পূজা শুরু হয়।
হিন্দু পুরাণের সমুদ্র মন্থনের কাহিনিতেও নাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। দেবতা ও অসুররা যখন সমুদ্র মন্থন করে অমৃত লাভের চেষ্টা করছিলেন, তখন মন্থন দণ্ড হিসেবে মন্দার পর্বত এবং মন্থন রজ্জু হিসেবে বাসুকি নাগকে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই মন্থনের ফলে বাসুকি নাগের শরীর থেকে প্রচুর বিষ নির্গত হয়েছিল, যা মহাদেব পান করে সৃষ্টিকে রক্ষা করেছিলেন। এই কাহিনিতেও নাগের বিশাল অবদান এবং দেবতাদের প্রতি তাদের সেবাকে স্মরণ করা হয়।