কলকাতা, ২৪ সেপ্টেম্বর : শিরোনাম টা কিন্তু একটুও কষ্টকল্পনীয় নয়। দক্ষিণ কলকাতায় ইতিহাসের স্মৃতিজড়ানো একটি প্রাচীন দুর্গা দালান 'গিরিশ ভবন' নামে যা পরিচিত আজ শিরোনামে নতুন করে উঠে এল। ১৮৩২ খ্রীস্টাব্দে এই বনেদী বাড়ির পুজো শুরু হয়েছিল প্রখ্যাত গুড় ব্যবসায়ী শ্রী হরচন্দ্র মুখার্জির তত্ত্বাবধানে। তাঁর পুত্র গিরীশ মুখার্জির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নির্মিত হয় বর্তমানের ঠাকুরদালানটি। গিরীশ বাবু একসময় সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করতেন কিন্তু সেই চাকরি ছেড়ে তিনি বিদ্যাসাগরের পরামর্শে ওকালতি পড়ে মুন্সিফের চাকরি নেন। পরে সেটিও ছেড়ে দিয়ে তিনি স্বাধীনভাবে ওকালতি শুরু করেন। শোনা যায় তিনি প্রতি মাসের জলপানির ৭আনা পয়সা সঞ্চয় করে সেই পয়সায় বর্তমান ঠাকুরদালানটি ক্রয় করেন। বিদ্যাসাগরের বহু আলোচিত সম্পত্তির উইলেও এই গিরীশ বাবুর স্বাক্ষর ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।বাঙালীর চোখের মণি উত্তমকুমারের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল এই ঠাকুরদালানেই। সেও এক ইতিহাস। পুজোর দিনগুলোতে সারা রাত যাত্রাপালার আয়োজন হত। অভিনয় থেকে শুরু করে যাবতীয় আয়োজনের দায়িত্বে থাকতেন উত্তমকুমার স্বয়ং। ১৯৭৫ এর পুজোয় শেষবার এই দালানে তিনি অভিনয় করেছিলেন। পুজোতে সেই সমারোহের ঐতিহ্য আজও বহন করে চলেছেন গিরীশ ভবনের সদস্যবৃন্দ। এবার ১৯০ বছরে পড়ল এই পুজো। কিন্তু সেই ঐতিহ্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ হতে চলেছে। আমরা সবাই জানি "গঙ্গা" ভারতের জনজীবনে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নদী। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জলবাহী এই নদী গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে সৃষ্টি হয়ে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সাগরে মিশেছে। ভারতবাসীর মনে একটি ধর্মীয় বিশ্বাস আছে, গঙ্গার পুণ্যতোয়া জলে দেহমনের সব কলুষ দূর হয়ে যায়।কিন্তু দুঃখের বিষয় গঙ্গার জলই যেখানে দূষণে কলুষিত, সেই নদী মানুষের মঙ্গল করবে কি করে!বিভিন্ন স্থানে বাঁধের কারণে এমনিতেই এর প্রবাহমাত্রা কমে গেছে তার ওপরে সীমাহীন দূষণে অচিরেই যে তার গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটবে তাতে আর সন্দেহ কী! সব পরিবেশপ্রেমীরা আজ গঙ্গার নির্মল ও অবিরল ধারা" বজায় রাখতে কাজ করে চলেছেন। গঙ্গার বাধাহীন প্রবাহমানতার এই উদ্যোগে কলকাতার গিরীশ ভবনের সাবেকি পুজোও আজ সামিল।সেটা এদের এবারের উদ্যোগ। আঠারোশো বত্রিশ সাল থেকে ' গিরিশ ভবনে' আন্তরিক ভক্তি, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস দিয়ে মা দুর্গার আরাধনা হয়ে আসছে।এখানে "মা" তাঁর সন্তান সন্ততিদের নিয়ে এক চালায় অবস্থিতা। এবছর গিরীশভবনের মূর্তি নির্মাণে এক বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে মায়ের বিসর্জন যাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। যে কাঠামোয় প্রতিবার পুজো হয় এবারে তা পালটে ধাতুর ধাঁচা করা হয়েছে প্রতিটি মূর্তি আলাদা ভাবে কাঠামো থেকে খুলে নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। শাস্ত্রমতে দশমীর সকালে গঙ্গাজলে দর্পণ বিসর্জন হবে কিন্তু এবার প্রতিবারের মত মূর্তিগুলি কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন না করে, গিরীশ ভবনের প্রাঙ্গণেই কৃত্রিম জলস্রোতের সাহায্য নেওয়া হবে। গলে যাওয়া মাটি সংরক্ষণ করে আগামী বছর পুণরায় ব্যবহার করা হবে প্রতিমা গড়ার কাজে। এর মূল উদ্দেশ্য হ'ল গঙ্গার দূষণ রোধ করা।অর্থাৎ পুজোয় ধর্ম ও পরিবেশ সংরক্ষণ দুটিই একসঙ্গে পালিত হল। এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পুনর্রূপায়ন ও পুনর্ব্যবহার। পরিবেশরক্ষার তিনটি নীতিই এখানে সফল" বলে মনে করছেন প্রযুক্তিবিদ সোমেন্দ্রমোহন ঘোষ। একটি বনেদীবাড়ির পুজোতে ধর্ম বিজ্ঞান ও পরিবেশ সংরক্ষণের এই অভিনব সংমিশ্রণ অন্য পুজোগুলোকেও উদ্বুদ্ধ করবে। ৫ অক্টোবর বিকেলে শতশত মানুষ এই দালানে বিসর্জন প্রত্যক্ষ করবেন পরিবেশবিদ সমীর বোসের কথায়, “গঙ্গার নির্মল ও অবিরল ধারা বহমান থাকুক।”