Festival and celebrations

6 days ago

Ras Utsav: রাস মানেই বৈষ্ণব নয়! শান্তিপুর যখন প্রেমের রসে মাতোয়ারা, নবদ্বীপে তখন শাক্ত রূপে দেবী

ras-utsav-2025-
ras-utsav-2025-

 

দূরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্ক:  শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধার প্রেমলীলার উৎসব রাস। বাঙালির প্রাচীন এই পার্বণটি বৃন্দাবনে গোপীদের সঙ্গে গোলকবিহারীর আনন্দলীলাকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও এর ইতিহাসে রয়েছে দ্বিমত।কথিত আছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পাপমোচন এবং তথাপি পূর্ণলাভের কারণে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান, আর সেই থেকেই শুরু হয় ‘রাস মেলা’। আবার একটি মতানুসারে, দুর্গাপুজোর পর পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে 'লীলা'-য় মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ । আর সেই থেকেই কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে 'রাস-লীলা' পালিত হয়ে আসছে ।

পদ্মপুরাণে শারদরাস এবং বাসন্তীরাস এই দুই রাসের উল্লেখ পাওয়া যায় । আবার, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে (ব্রহ্মখণ্ড, পঞ্চম অধ্যায়) বাসন্তীরাস এর উল্লেখ মেলে । আরও প্রামাণ্য তথ্য অনুযায়ী, শ্রীমদ্ভাগবত এবং বিষ্ণুপুরাণে শুধুমাত্র শারদরাসের বর্ণনা আছে । হরিবংশে ও ভাসের বালচরিতে উল্লেখ আছে যে, কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে হল্লীশনৃত্য করেছিলেন । হল্লীশনৃত্য যদি তালযুক্ত ও বিবিধ গতিভেদে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় তবে তাকে 'রাস' নামে অভিহিত করা হয় ।

বিষ্ণুপুরাণে উল্লেখ রয়েছে, কৃষ্ণ রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন গোপীদের সঙ্গে। এর পাশাপাশি রাসলীলায় যে নৃত্য পরিবেশন করা হয় তাই 'রাসনৃত্য' নামে পরিচিত । 'রাসনৃত্য' গোলাকার মণ্ডপে কখনও একা, কখনও দ্বৈত কিংবা কখনও দলবেঁধে হয় । অদৃশ্য রসের দৃশ্যমান রূপই হল রাস ৷ বলাবাহুল্য, এই 'রাসনৃত্য' মোট পাঁচ ভাগে বিভক্ত । যেমন, 'মহারাস', 'বসন্ত রাস', 'কুঞ্জরাস', 'দিব্যরাস' এবং 'নিত্যরাস'। এরমধ্যে 'মহারাস' জাঁকজমকপূর্ণ । রাসনৃত্যের মূল বিষয়বস্তু হল রাধা এবং তাঁর সখীদের নিয়ে । মোটামুটি বাংলা, মৈথিলী, ব্রজবলি এবং মৈতৈ কবিদের পদাবলি থেকেই রাসনৃত্যের গীত গাওয়া হয় । এছাড়া ভারতের উত্তরপ্রদেশের মথুরা ও বৃন্দাবনে, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়াসহ অন্যান্য জায়গায়, ওড়িশা, আসাম এবং মণিপুরে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা উৎসব উদযাপিত হয় ।


তবে, বৈষ্ণবদর্শনে রাস উৎসবের যে ব্যাখ্যাই থাকুক না কেন, বাংলার নবদ্বীপে রাসের চেহারা একেবারে 'বিপরীত'। রাস নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ উৎসব । শরৎকালে শারদোৎসবের পরেই শুরু হয় এই উৎসবের প্রস্তুতি । কার্তিকীপূর্ণিমায় এখানকার রাসের প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে, বিরাট বিরাট মূর্তির বিশালতা । অপরূপ মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে শক্তি আরাধনাই নবদ্বীপের রাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য । প্রতিটি মূর্তিতে কারুকার্যময় নির্মাণশৈলী, সমস্ত শিল্পীর নিখুঁত চিত্রায়ণ—যা বহু মানুষের মনোরঞ্জনে সাহায্য করে ।

পূর্ণিমার দিন, তন্ত্রমতে শতাধিক শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজো হয় নবদ্বীপে, সেই সঙ্গে দেবী শক্তির জয়ধ্বনি করা, এটাই হল নবদ্বীপের রাসের সংজ্ঞা । রাস পূর্ণিমার রাতে দেড়শোর বেশি শক্তিমূর্তির পুজোর কারণে নবদ্বীপের রাসকে 'শাক্ত রাস' বলেই অভিহিত করেন । নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময় রাসের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয় । মহারাজা হওয়ার পর থেকে 1750 পর্যন্ত কৃষ্ণচন্দ্র নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকতেন । এরপর তিনি মন্দির স্থাপন এবং বিভিন্ন উৎসব, বহু জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে মনোনিবেশন করেন ।

বলাবাহুল্য, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজে ছিলেন শাক্ত । নদিয়া, অগ্রদ্বীপ, কুশদ্বীপ এবং উলা এই চার সমাজের সমাজপতি ছিলেন তিনি । তাঁর রাজত্বে শক্তিসাধনা দিকে দিকে হোক এটাই তিনি চাইতেন । এর পাশাপাশি তিনি পছন্দ করতেন না মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবকে মঠে-মন্দিরে পুজো করা হোক । তবে তিনি বৈষ্ণববিদ্বেষী ছিলেন না, কিন্তু চৈতন্যদেবকে যাঁরা অবতার বলে পুজো করতেন তাঁদের তিনি ঘোর অপছন্দ করতেন বলেই উল্লেখ পাওয়া যায় । আর নবদ্বীপে তাই রাস উৎসবের আলাদা আনন্দ মেলে ।

তবে নদীয়ার শান্তিপুরে শ্রীরাধা এবং শ্রীকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ নিয়েই রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যে ধারাও বহুপ্রাচীন । তবে শান্তিপুরের এই রাস উৎসবের কেন্দ্রে থাকেন ওই অঞ্চলের বড় গোস্বামী বাড়ির শ্রীরাধারমণ । মূলত, তাঁকে কেন্দ্র করেই গোটা এলাকার মানুষজন রাস উৎসবে মেতে ওঠেন ।

প্রসঙ্গত, শ্রীঅদ্বৈত পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর বড় পুত্র রাঘবেন্দ্র থেকে এই বাড়ির সৃষ্টি । কথিত আছে, ঈশ্বর দর্শনের উদ্দেশ্যে ভারত ভ্রমণে বেড়িয়ে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য নেপালের গণ্ডকী নদী থেকে এক নারায়ণ শিলা প্রাপ্ত হন । সেই শিলা তিনি শান্তিপুরে নিজ বাড়িতে এনে পূজা করতেন । আচার্যদেবের সেই নারায়ণ শিলা আজও নিত্য পূজিত হন বড় গোস্বামী বাড়িতে । এই বাড়ির প্রধান দেবতা শ্রীশ্রীরাধারমণ জীউ । এই মূর্তি আগে পুরীতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে দোলগোবিন্দ নামে পূজিত হতেন । পরবর্তীকালে বারোভুঁইয়া পরিবারের বসন্ত রায় তাঁকে যশোরে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন । কিন্তু 1592 খ্রিস্টাব্দে মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে মূর্তির পবিত্রতা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বসন্ত রায়ের পরিবার এই কৃষ্ণমূর্তি তুলে দেন তাঁদের গুরুদেব অদ্বৈতপৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে । মথুরেশ গোস্বামী সেই মূর্তি নিয়ে এসে নিজের শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীশ্রী রাধারমণ জীউ নামে । এছাড়া বড় গোস্বামী বাড়িতে রয়েছেন শান্তিপুরের একমাত্র ষড়ভুজ মহাপ্রভু মূর্তি, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য, সীতাদেবী ও পুত্র অচ্যুতানন্দের দারুমূর্তি ও কষ্টিপাথরের শিবমূর্তি ।

এই যুগল বিগ্রহকে নানালঙ্কারে সজ্জিত করে সারা শান্তিপুর শোভাযাত্রা করে ঘোরানো হয় রাস উৎসবে । রাধারমণের পাশে রাধারানীকে প্রতিষ্ঠা করা হয় রাস উৎসবের সময় । বলাবাহুল্য, এই শোভাযাত্রা সৃষ্টি করে বিখ্যাত ভাঙারাস উৎসব । রাধারমণ ও শ্রীরাধিকার বরবেশের শোভাযাত্রার পিছনে বরযাত্রী রূপী শান্তিপুরের সকল পূজিত যুগল বিগ্রহ সুসজ্জিত হয়ে অংশ নেন, এই অনুষ্ঠানটি সম্পূর্ণ সংগঠিত করেন খাঁ চৌধুরী বাড়ি (খাঁ চৌধুরীরা হলেন বড় গোস্বামী বাটীর শিষ্য)। ভাঙারাসের পরের দিন বড় গোস্বামী বাড়ির সব যুগল বিগ্রহকে নানা অলঙ্কারে সজ্জিত করে অনুষ্ঠিত হয় 'কুঞ্জভঙ্গ' বা ঠাকুর নাচ ।

পাশাপাশি, শান্তিপুরের রাস উৎসবের আরও এক বাড়ি হল মধ্যম গোস্বামী বা হাটখোলা গোস্বামী বাড়ি । বৈষ্ণবকুলচূড়ামণি শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের প্রপৌত্র ঘনশ্যাম গোস্বামী থেকে এই মধ্যমগোস্বামী বাড়ির সৃষ্টি । এই বংশের আদি বিগ্রহ শ্রীশ্রীরাধাবিনোদ জীউ । ঘনশ্যাম গোস্বামীর পুত্র রঘুনন্দন গোস্বামী ছিলেন এই বংশের প্রাণপুরুষ । তিনি ন্যায়, অলংকার এবং তর্কশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন । শ্রীরঘুনন্দন একাধারে অগাধ পাণ্ডিত্য এবং অন্যদিকে অনন্ত ভক্তিমান হওয়ায় ব্রহ্মচারী দণ্ডিমহারাজ যুগল বিগ্রহের সেবার দায়িত্বভার তাঁকে অর্পণ করেন । একদিন রঘুনন্দন স্বপ্নে দেখেন শ্রীশ্রী গোকুলচাঁদ জীউকে । প্রায় সাড়েসাতশো বছর ধরে সেই রাধাগোকুলচাঁদ জীউ পূজিত হয়ে আসছেন গোকুলচাঁদ বাটীতে । শান্তিপুরের রাস উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয় গোকুলচাঁদ বাটীতে । ভাঙারাসের শোভাযাত্রায় শ্রীবিগ্রহ নগরপরিক্রমা করেন বড় গোস্বামী বাড়ির মতন । এর পরদিন কুঞ্জভঙ্গ বা ঠাকুর নাচানো উৎসব যথাযথভাবে পালন করা হয় এই বাড়িতেও ।

প্রসঙ্গত, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের তৃতীয়পুত্র বলরাম মিশ্রের কনিষ্ঠপুত্র কুমুদানন্দ থেকে এই পাগলা গোস্বামী বাড়ির সৃষ্টি । শান্তিপুরের প্রাচীন মন্দিরের অন্যতম এই দুই মন্দির এবং বিগ্রহ । পাগলাগোস্বামী বাড়ির দুই বিগ্রহ কৃষ্ণ রায় ও কেশব রায় জীউ । এই পরিবারের পুর্বপুরুষ অদ্বৈতাচার্য্যের চতুর্থপুত্র শ্রী বলরামের দশম পুত্র কুমদানন্দ গোস্বামী ছিলেন পণ্ডিত ও সাধক । কথিত আছে কৃষ্ণনগর রাজ কর্তৃক প্রদত্ত সম্পত্তি প্রত্যাখ্যান বা নষ্ট করায়, তাঁহার 'আউলিয়া' নামে খ্যাতি রটে এবং সেই জন্যই এই শাখার নাম আউলিয়া বা পাগলাগোস্বামী । কুমদানন্দের দ্বারা 'কৃষ্ণরাই' প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাঁচ বছর পর পুনরায় 'কেবশরাই' প্রতিষ্ঠিত হন ।

বলরামের কনিষ্ঠপুত্র কুমদানন্দ গোস্বামী, তাঁকে নারায়ণ শিলা দিয়েছিলেন অদ্বৈতাচার্য্য । রাসের সময় রাসমঞ্চে একই সঙ্গে দুই বিগ্রহ পূজিত হন । বিগ্রহের বয়স প্রায় আনুমানিক 450বছর । রাসমঞ্চে বিগ্রহ স্বর্ণালংকারে সাজানো থাকে সেই বিগ্রহ । এটি তৈরির পাঁচবছর বাদে তৈরি হয় গৌরনিতাই । বংশের হরিনাথ গোস্বামীর স্ত্রী অদ্বৈতমহাপ্রভু ও তাঁর স্ত্রী সীতাদেবীকে মূর্তি আকারে প্রতিষ্ঠা করেন । এই পরিবারে অন্নভোগ নিবেদন করা হয় ।

উৎসবের দিন সকালে মঙ্গলারতি হয় এবং বাল্যভোগে ক্ষীর, মাখন, মিষ্টি, ছানা, নাড়ু ইত্যাদি নিবেদন করা হয় । দুপুরে শাক, শুক্তনি, ডাল, মোচার ঘণ্ট, পটলের তরকারি, ফুলকপির তরকারি, পোলাও, পরমান্ন, দই, চাটনি ইত্যাদি নিবেদন করা হয় । সন্ধ্যায় আরতি হয় । পাশাপাশি, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের পুত্র বলরামতনয় দেবকীনন্দন থেকে এই আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির সৃষ্টি । কথিত আছে, এই স্থানে আগে অনেক আতা গাছ ছিল । সেই আতা বন কেটে এই বাড়ি স্থাপন হয়েছিল বলে এই বাড়ির এমন নাম । যদিও বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই বাড়ির পরিচয় বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বাড়ি বলেই । কথিত আছে, অদ্বৈত প্রভু বলরাম আর দেবকীনন্দনের শ্রীশ্রী রাধাশ্যামসুন্দর শ্রী বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাকার্য স্বহস্তে করেছিলেন এবং দেবকীনন্দনের নির্দিষ্ট করে যাওয়া নিয়মবিধি অনুযায়ী আজও সেই বিগ্রহের সেবাপূজা হয়ে আসছে ।

এই বংশেই 177বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী । তিনি অদ্বৈতাচার্যের অধস্তন দশম পুরুষ । বিজয়কৃষ্ণ প্রথম জীবনে ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত হন । তাঁর পিতা আনন্দচন্দ্র গোস্বামী ছিলেন শ্যামসুন্দর অন্তপ্রাণ । এই রাসযাত্রা বিশাল সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়িতে । রাস উৎসবের তৃতীয়দিনে রাধাশ্যামসুন্দরের শোভাযাত্রা হয় ।

You might also like!